JustPaste.it

মাওয়াযে থানুভী রহ. থেকে নির্বাচিত কাহিনী

========================================================================

 

উম্মতের কামালাত মূলতঃ নবীর সংসর্গেরই বরকত

        আবদুল্লাহ ইবনে সায়াদ ইবনে আবু সায়াদ ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাতেবে অহি ছিলেন। হুযুর (সাঃ)-এর সাহচর্যের বরকতে এক সদ্য নাজিল হওয়া একটি আয়াত রাসূল (সাঃ) বলার আগেই তার মুখ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাে। ঘটনাটি হলােঃ রাসুল (সাঃ) একবার তাকে ডেকে সদ্য অবতীর্ণ এই আয়াতগুলাে লিখতে বললেনঃ

 

        রাসূল (সাঃ) এতটুকু পাঠ করার পর কাতেবের মুখ দিয়ে অবলীলাক্রমে বের হয়ে এলোঃ

 

        রাসুল (সাঃ) বললেন, এই অংশটুকুও অহির মাধ্যমে আমার নিকট অবতীর্ণ হয়েছে।

 

        সত্যই এটা হলো রাসূল (সাঃ) এর সংসর্গের বরকত। রাসূলের মানসিক প্রভাবের ছাপ তার ওপর পতিত হওয়ায় রাসূলের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার পূর্বে অবলীলায় তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসেঃ

 কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে সায়াদ দাবী করে বসলাে, আমিও নবী। এই অহি আমার উপর নাযিল হয়েছে। সত্যই তার আত্মার ধারণ ক্ষমতা একেবারেই সামান্য ছিলাে। তাই অল্পতেই সে দিশা হারিয়ে নিজেকে নবী দাবী করে বসে। তাকে কেন্দ্র করেই পরে এ আয়াত নাজিল হয়ঃ

 

        অপর দিকে হযরত উমর (রাঃ) এর কথা ভেবে দেখুন। বার বার তাঁর মতের অনুকূলে অহি নাজিল হয়েছে। মাঝে মাঝে ওমর (রাঃ)-এর মুখ নিসৃত বাক্য হুবহু অহিরূপে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কখনাে উমর (রা)-এর মনে একথা উদিত হয়নি যে, আমি একটা কিছু হয়ে গেছি বা আমার উপরও অহি অবতীর্ণ হচ্ছে। কারণ তিনি বুঝতেন যে, রাসুল (সাঃ)-এর সাহচর্যের বরকতে হৃদয়ে যে নূরানী ভাব সৃষ্টি হয়েছে তার কারণেই এসব হচ্ছে। মাঝে মাঝে কোন বিষয়ে অহী নাজিল হওয়ার পূর্বেই তার হৃদয়ে সে বিষয়ে ভাল মন্দ স্পষ্ট হয়ে যেতাে। কিন্তু তিনি কখনাে এ নিয়ে অহংকার বা গর্ববােধ করেননি। উপরন্তু দেখা গেছে, কোন ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) ও উমর (রাঃ) এর মত ভিন্ন ভিন্ন হলে উমর (রাঃ)-এর মতের অনুকূলেই অহী নাজিল হয়েছে। তখন উমর (রাঃ) আনন্দিত হওয়াতাে দূরে কথা বরং কয়েকদিন পর্যন্ত লজ্জায় জড়ােসড়াে হয়ে থাকতেন।

 

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)-এর মর্যাদা

        যৌবনে শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এক বুযুর্গের সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। সাথে আরাে দু’জন সাথী ছিলাে। তাদের মধ্যে পরস্পরে ওই বুযুর্গের নিকট যাওয়ার কারণ প্রসংগে আলাপ হচ্ছিলো। তখন একজন বললো, শুনেছি, তার দোয়া খুব মকবুল, তাই তার দ্বারা জীবনে স্বচ্ছলতা আসার জন্য দোয়া করাবে। অপর ব্যক্তি ছিলেন আলিম। তার নাম ইবনুস সাকী। তিনি বললেন, আমি তাকে পরখ করার জন্য যাচ্ছি। তিনি কি শুধু বুযুর্গ না ইলম আলামত কিছু আছে তা দেখব। আমি তাকে এমন কঠিন প্রশ্ন করব যার উত্তর দেওয়া সাধারণ লােকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তারপর তারা আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা আপনি কিসের জন্য যাচ্ছেন? জওয়াবে তিনি বললেন, আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য হলাে, “তিনি একজন আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি। তার সাক্ষাতে আমার আত্মার সংশোধন হবে। এ অসিলায় আমার প্রতি আল্লাহর দয়া হবে”।

 

        তারা বুযুর্গের নিকট পৌছার পূর্বেই কাশফের মাধ্যমে তিনি তাদের মনের অবস্থা জেনে ফেলছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের কিছু বলার পূর্বেই বুযুর্গ তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শুরু করেন। যে ব্যক্তি দুনিয়াবী স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় তার নিকট গিয়েছিলাে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমি দেখছি যে, বহু পরিমাণ স্বর্ণ ও চাদি তােমার পদতলে স্তুপ হয়ে আছে।”

 

        তারপর ইবনুস সাবার দিকে ফিরে বললেন, তােমার একটি প্রশ্ন হলাে, এই আর তার উত্তর হলাে এটা। এভাবে ক্রমান্বয়ে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন, তবে আমি তােমার চেহারায় কলংকের নােঙ্গর দেখতে পাচ্ছি। তােমার মুরতাদ হয়ে যাওয়ার আশংকা আমার কাছে সুনিশ্চিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পরে তাই হয়েছিলাে। আলিম হিসাবে তার নাম ডাক থাকায় তৎকালীন খলীফা তাকে হিরাক্লিয়ার্সের নিকট দূত হিসাবে পাঠান। কিন্তু, ওখানে পৌছে সে হিরাক্লিয়াসের মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং খৃস্টান অবস্থায়ই তার মৃত্যু ঘটে। এর পর তিনি আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি দেখছি যে তুমি বাগদাদের মিম্বারে বসে বলছােঃ আমার পা সকল আওলিয়াদের উপর। আর আমি দেখছি যে, আওলিয়াদের গর্দান তখন নত হয়ে আছে। ওই বুযুর্গের সেদিনের কাশফ ছিলাে সত্য এবং বাস্তব। তখন বুযুর্গ এ  কথা বলছিলেন তখন জিলানী (রঃ) ছিলেন যুবক মাত্র। কেউ তখন ধারণাও করতে পারেনি এই যুবক পরবর্তীতে এতাে উচু মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। ওই বুযুর্গের কথা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে পরিণত হয়েছিলাে। পরবর্তীকালে একদিন আব্দুল কাদের জিলানী রঃ বাগদাদের মিম্বরে বসে ওয়াজ করছিলেন।

 

        ওয়াজের মাঝখানে অত্যন্ত জযবায় উদ্বেলিত হয়ে তিনি বলেনঃ ধরাপৃষ্ঠে যত অলি ছিলেন সকলে তার এ  দাবী মেনে নেন। তার এ কথা তখনই পৃথিবীর সকল অলী বুযুর্গদের নিকট পৌঁছে যায়। প্রশ্ন হতে পারে যে, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)-র ওই কথা তখন গােটা পৃথিবীর আওলিয়া বুযুর্গগণ শুনলো কিভাবে?

 

        আল্লাহ তাআলা সব কিছুতেই সক্ষম। তিনি যেভাবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর হজ্জের আহবানকে তৎকালীন সারা বিশ্বের মানুষের নিকট পৌঁছিয়েছেন। এমনকি রূহ জগত থেকে রূহেরা পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাে, তেমনিভাবে আবদুল কাদের জিলানী (রঃ)এর আওয়াজও সকল বুযুর্গগণের নিকট পৌছিয়েছিলেন।

 

গেলে আর কোথায়-ই বা যাবাে

        শেখ সাদী এক বুযুর্গের কাহিনী বর্ণনা করে বলেছেন, একরাতে তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য উঠলে আল্লাহর পক্ষ থেকে শুনতে পান, তুমি যত কিছুই করাে না কেন তা আমার নিকট কবুল হবে না।” আওয়াজটি এত জোরে হয়েছে যে, ওই বুযুর্গের এক মুরীদ তা শুনে ফেলে। যাক সে রাত তাে তিনি অত্যন্ত বিনয় নম্রতার সাথে নামায পড়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন রাতেও আবার যথা সময়ে নামাযের জন্য উঠলে মুরীদ আশ্চর্য হয়ে তাকে বললাে, এটা কেমন নিচু মানসিকতার কথা যে, আল্লাহ তাে আপনার কোনও আমল কবুল করছেন না অথচ আপনি তারপরও লেগে আছেন। শাইখ শান্ত ভাবে তাকে বললেন, আল্লাহ তােমার কল্যাণ করুন। তুমি যা বলছে তাতো ঠিকই। কিন্তু তুমি বলো, তার দরবার ছেড়ে কোথায় যাবাে? তার দরবারে ধরনা দেয়া ছাড়া অন্য কোন দরবার আছে কি? কবুল হােক বা না হােক তা আমার দেখার বিষয় নয়। আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার এ দাসােচিত কথায় তার প্রতি আল্লাহর রহমত উথলে উঠলাে। যেন তাকে একথাই বলা হলােঃ

 

        “তোমার মাঝে এছাড়া আর কোন প্রশংসনীয় গুণ না থাকলেও তোমার সব কিছু কবুল করে নিলাম। এ কারণে যে, তুমি বিশ্বাস কর, আমাকে ছাড়া তােমার কোন আশ্রয় নেই।” সত্যিকার আল্লাহ প্রেমিকদের অবস্থা এমনই হওয়া দরকার। বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েও প্রেমাস্পদের দুয়ারে পড়ে থাকতে হয়। তাই শেখ সাদী বলতেন,

        হে আল্লাহ যদি আপনি আমাদের দোয়া কবুল না করেন তাে কে কবুল করবে!

 

        আল্লাহ অবশ্যই এমন আশিকের দোয়া ও ইবাদত কবুল করেন। তার রহমত ও সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হলেও যদি তারই রহমতের আশায় তার দরবারে ধরণা দেয়, তবে আল্লাহ তার প্রেমিক বান্দাদের পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেন যে, প্রেমিকের প্রেম নিখাদ কিনা।

 

আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে সুসম্পর্কের বরকত

        হযরত থানুভী (রঃ) বলেন, ইংল্যাণ্ডে বসবাসকারী এক পরসী আমাকে বলেছে, সে তার পেশায় খুবই দক্ষ ছিলাে আর চাকুরীর ব্যাপারে তার ভাগ্য এত প্রশস্ত যে, যখনই চাকুরীর জন্য কোথাও চেষ্টা করে তাে চার পাঁচশত টাকার চাকুরী অনায়াসেই সে পেয়ে যেতাে। কিন্তু তার স্বভাবে চঞ্চলতা থাকার কারণে কখন-ই সে কোন কাজ স্থিরতার সাথে করতে পারেনি। তার কথা, সে খুব যােগ্য ও প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় ব্যাপারে সে ছিলাে একেবারেই অজ্ঞ। এ কারণে তার জীবনে এসব অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটেছে। একবার সে সাহাবাদের জীবনী-ইতিহাস পড়ছিলো। তখন রমযান মাস, সে রােযাও রেখেছিল। তাতে লিখিত ছিলাে, সাহাবীগণ কোন এক দেশে গিয়ে সেদেশের কাফের বাদশাহর নিকট প্রস্তাব দিলাে যে, তুমি ইসলাম গ্রহণ করাে অন্যথায় জিজিয়া দাও। আর দুয়ের কোনটি না হলে তরবারীই তােমার ভাগ্যের চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। এ ঘটনার পর তার মনে একটা শব্দ দারুন ভাবে সংশয় সৃষ্টি করে যে, তবে কি ইসলাম ধর্মের মূল্য এতটুকু যে ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে কিছু জিজিয়া দিলেই চলবে?

 

        এর মুল অর্থ হলাে, জিজিয়া বা সামরিক কর দানের মাধ্যমে একজন অমুসলমান পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে পারে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে তাকে বাধ্য করা হয়না। এই সহজ অর্থ সে বুঝল না। এই উল্টো চিন্তা এমন ভাবে তার হৃদয়ে বসলাে যে, সে ইসলাম ধর্মের সত্যতাই অস্বীকার করে বসে। তারপর মনে মনে ভাবলাে, যখন ইসলামের কোন সত্যতাই নেই তখন রােযার অস্তিত্বই তাে থাকে না। তাই সে পানি পান করে রােযাও ভেঙ্গে ফেললাে।

 

        এরপর তার মনে অনুশােচনা জাগ্রত হলাে যে, এতােদিন সে মুসলমান ছিলাে, এখন আবার কী শুরু করলাে। প্রতিদিনের মত সন্ধায় এক বন্ধুর নিকট গেলে তারা তাকে ইফতারে শরীক হওয়ার জন্য ডাকলে সে বললাে, ভাই আমি তাে এখন এক কঠিন অবস্থায় আছি যদি তােমরা তা জানতে হবে -তােমরা আমাকে পাশেই বসতে দিতে না। বন্ধু বললাে, এর চেয়ে তাে আর বেশী হতে পারে না যে, তুমি কাফের হয়ে গেছে। যদি তাই হয় তবে তাতাে আল্লাহর ইচ্ছা! ওর কোন প্রতিক্রিয়া আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে শিথীলতা সৃষ্টি করতে পারে না। অবশ্য সে এসব কথা তাকে তার মনােরঞ্জনের জন্যই বলেছিলাে। খাবার দাবারের পর যখন তাকে বাস্তব ঘটনা জিজ্ঞাসা করলাে এবং তার মুখে বিস্তারিত বিবরণ শুনলাে তখন তারা বললাে, তুমি আমাদের খাতিরে অন্ততঃ একবার মাওলানা ফজলুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ কর। আমাদের কথা শুনে সে হেসে বললাে, কুরআন হাদীস ছাড়া এ দার্শনিক তত্ত্বের তিনি কি জানেন। আর আমার সন্দেহেরই বা কি উত্তর দিবেন। তারা বললাে, আচ্ছা ভাই, আমাদের খাতিরে তুমি একবার তার সাথে দেখা করাে, তারপর কথা বলব। সে বললাে, আচ্ছা তােমাদের খাতিরেই একবার তার কাছে যাব।

 

        অতপর একদিন সে মাওলানা সাহেবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাে। অধিকাংশ পথই সে পায়ে হেটে গেলাে। যেন সে তার নিকট ঠিক প্রশ্ন-উত্তরের সময় গিয়ে উপস্থিত হয়, পথে পথে সে অনেক প্রশ্ন ঠিক করে রাখে। কিন্তু গিয়ে যখন আসসালামু আলাইকুম বললাে এবং মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেব তার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তােমার কি এ ব্যাপারে সন্দেহ হয়?” তখন আমার সমস্ত জটিল প্রশ্নের উত্তর আমার হৃদয়ে এসে হাজির হয়ে মনের অবস্থা এমন হলাে যে, মাওলানা বার বার জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। অবশেষে আমার হৃদয়ে আর কোন প্রশ্ন বাকী রইল না। হৃদয় আয়নার মত পরিস্কার হয়ে গেলাে। তখন আমি তাকে বললাম, আমাকে বাইয়াত করে নিন। তারপর আমি তার বাইয়াত গ্রহণ করলাম। থানুভী (রঃ) বলেন, তারপর থেকে সে প্রায়ই বলতাে, আমলের ব্যাপারে তাে আমার মাঝে অনেক অলসতা আছে। কিন্তু এরপর থেকে আকায়েদ বা বিশ্বাসগত দিক থেকে কখনাে আমার হৃদয়ে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হয়নি।

 

        সত্যই আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার এটাই বরকত। তাই এ ব্যাপারে নিজেরও গুরুত্ব দেয়া দরকার এবং ছেলে মেয়েদের ব্যাপারেও এদিকে খেয়াল করা উচিত।

 

অনুবাদঃ ম, আ, মাহদী

 

═──────────────═